যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আগস্ট মাসের শেষ দিকে।লকডাউন–আর তার সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ,
এর মাঝে পরিবার কে সুস্থ রাখা – বাবা ও মায়ের দেখভাল ছোট্ট বোনটার যত্ন বাইরের কাজ
তার সাথে অনলাইন ক্লাস, এইসব কিছু নিয়ে একা শুভদীপ চলছিল, হঠাৎ মারণ রোগ যা নিয়ে
সমগ্র পৃথিবী ভয়ার্ত , তটস্থ সেই করোনার কবলে পড়ে গেল শুভদীপ।
প্রথম কয়েকটা দিন বুঝেও মনকে প্রবোধ দিতে শুরু করেছিল –
লক্ষণ গুলো ঠিকঠিক বুঝতে পেরেছিল –ক্রমশ একটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাব চলে যাচ্ছিল-
মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল , একটা হাল্কা জ্বর —-তবু মনকে প্রবোধ দিত ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়তো।
কিন্তু যা ঘটার তা তো অবশ্যম্ভাবী , অতঃপর সেই টেস্ট এবং রিপোর্ট পজিটিভ,
পাশাপাশি ছোট্ট বোন এবং মা কাবেরী দত্ত আক্রান্ত হলেন।
শুরু হল মনের সাথে পরিস্থিতির লড়াই।লড়াইটা আরও জটিল স্তরে পৌঁছে গেল
যখন সংসারের প্রধান-অর্থাৎ শুভদীপের বাবা পার্থপ্রতিম বাবু আক্রান্ত হলেন,
আর সেই দৃশ্য কতটা নিদারুণ সেটা ভাষা য় বর্ণনীয় নয় ।প্রতি সেকেন্ডে ইনহেলার নিয়ে বাবা
শ্বাস নিচ্ছেন আবার শ্বাসের কষ্ট শুরু হচ্ছে।
যখন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তখন আরো বিপজ্জনক-শ্বাস কষ্টের শেষ সীমা ,
ক্রমশঃ জটিল হতে শুরু করল, শুভদীপ তখন লড়াকু সৈনিক, চোখের সামনে শুধু লড়াই যাওয়া ছাড়া
আর কোন পথ নেই, ডাক্তারের কঠোর নির্দেশে হাসপাতালে ভর্তি তো করা হল
কিন্তু মৃত্যুর অঙ্গুলিনির্দেশ–চলতেই থাকল সেই দিন সেই মুহূর্ত থেকে।
যুদ্ধটা যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ।একদিকে সব্যসাচী শুভদীপ অপরদিকে যেন দুর্যোধন সম
করোনা-বীণা যুদ্ধে সে সূচাগ্র মেদিনী সম বেঁচে থাকার অধিকার যেন সে দেবে না শুভদীপের পরিবারকে।
সেখানে শুভদীপ একটি তরুণ অসহায় কিন্তু সে স্থির করল-যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে সে ফিরে যাবেনা।
ভাবুন তো ,একজন করোনা আক্রান্ত তরুন তার বাড়ির আক্রান্ত মানুষগুলোকে
তার কাছের মানুষগুলোকে উৎসাহ দিয়ে চলেছে অথচ ঘাত প্রতিঘাতে সে জর্জরিত।
প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর যেন শব্দ কারণ বাবার অবস্থা আশঙ্কাজনক- প্রায় ভেন্টিলেশানে
দেওয়ার অবস্থা, রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যাচ্ছিল –ভেন্টিলেশানে রেখেও শ্বাস কষ্ট।
বাবা কথা বলতে পারতেন না সারে পাঁচটার ভিডিও কলটার জন্য ছটফট করত শুভদীপ।
একটু দেরী মানেই -তবে কী আর বাবা থাকবে না! বুকটা হিম হয়ে যেত।বদ্ধ ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসত।
কিন্তু অদ্ভুত তার মনের জোর—–
প্রথম দিকেই সে পাড়া এবং ক্লাব কে সম্পূর্ণ টা জানিয়েছিল,
কারণ করোনা–এটাই তো মানসিক চাপ আর একটি অ্যাপার্টমেন্ট এর চারজনেই আক্রান্ত মানে —
সামাজিক একটা প্রশ্ন-তবে কী এবার পাড়া ছাড়া হতে হবে ,প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে টি.ভি তে সোস্যাল মিডিয়ায়
যা শুনে দেখছে তাতে বোঝাই যায় মানুষ বর্বরতার চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গেছে,
শুভদীপ ভেবেই নিয়েছিল-যদি যেতেও হয় তবু সত্যি সে গোপন করবে না;
কিন্তু সব দরজা বন্ধ হলেও ঈশ্বরের দরজা খোলা থাকে; সকলে এক হয়ে শুভদীপের পরিবারের
পাশে এসে দাঁড়াল; এমনকী এক একদিন দরজা খুলে সামনে শুকনো খাবার-মনের
উৎসাহ দেওয়ার জন্য ডেয়ারি মিল্ক রাখা থাকত—কে দিত কেউ জানত না;
হয়তো কোন সান্টা–কাকু বা দাদা বা জেঠু–অথবা কোন একজন-তবে বন্ধুত্ব আর সহযোগিতা সকলে করেছিল।
এদিকে বাবার অবস্থা কিন্তু একই রকম–প্রায় চার সপ্তাহ বাবা যুদ্ধ করলেন।তারপর ধীরে ধীরে বাবা সুস্থতার দিকে এগিয়ে গেলেন।
প্রবল একটা ঝড় এসেছিল আবার চলেও গেল।
এই ঝড়ে শুভদীপ একা মাঝি , এই যুদ্ধের সফল সেনাপতি -তরুণ বায়োলজি টীচার শুভদীপ দত্ত।
খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করেছিলাম-ঐ দিনগুলো কীভাবে কাটাতে।
মুঠোফোনের ওপার থেকে হেসে বলেছিল—-কপিল শর্মার প্রোগাম দেখে মনটাকে হাল্কা রাখতাম
আর সবথেকে ভাল থাকতাম বাচ্চাগুলোর অনলাইন ক্লাসের সময় —
আর একটা গান সবসময় -তার গিটারে বেজে উঠত-“we shall overcome.
অনেক লড়াই -এর পর শুভদীপ এখন -ফিরে এসেছে , তার পরিবারের সকলে এখন সুস্থ।
-হ্যা, এত বড় একটা মারণ রোগ সেরে উঠলেও কিছু দিক আছে যেগুলো এখন ও সাবধানতার
সাথে মোকাবিলা করতে হয়, যেমন বয়স্ক বাবার ক্ষেত্রে একটু কথা মনে করতে না পারা,
একটু মানসিক একটা চাপ -তবে শুভদীপের মত যার সন্তান তার কোন ভয় টাই ভয় হয়ে থাকে না।
শুভদীপের চোখে একটু ক্লান্তির ছাপ—
তবে একটা স্মিত হাসি তার মুখে প্রতিভাত-কারন সে যুদ্ধ বিজয়ী শুভদীপ।